Taqwa academy blog

যাকাত প্রদানের নিয়ম

যাকাত এর শাব্দিক অর্থ  হলো বৃদ্ধি পাওয়া বা বেড়ে যাওয়া। যেকোনো, পূর্ণবয়স্ক সুস্থ ব্যাক্তি নারী অথবা পুরুষের বছর শেষে তার নিজের আয় ও সম্পত্তির একটা নির্দিষ্ট অংশ, ইসলামের শরিয়াহ মোতাবেক নিসাব পরিমাণ হয়ে থাকে এবং তা থেকে গরীব-দুঃস্থদের মধ্যে বিলি করার নিয়মকে জাকাত বলা হয়ে থাকে।

যাকাত ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের একটি। যাকাত আদায় ও বন্টন একদিকে যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত, তেমনি সামাজিক দারিদ্র্য দূর করে ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠনের ক্ষেত্রেও এটি একটি কার্যকরী উপাদান। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন যে, যাকাত প্রদান করা মুসলমানদের একটি ফরয দায়িত্ব বা কর্তব্য।

কুরআনপাকে মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত দাও এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।” (সূরা বাকারা: আয়াত ৪৩)

কুরআনপাকে মহান আল্লাহপাক বলেন, “(হে রসূল!), তাদের সম্পদ থেকে সাদাকাহ (জাকাত) গ্রহণ করুন, তাদের পবিত্র করুন ও ওদের জন্য (তাদের সম্পদ) বৃদ্ধি করুন।” (সূরা তাওবাহ : ১০৩))

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনে বলেছেন, যারা আল্লাহর পথে খরচ করে আল্লাহ তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করেন।

“যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের চিত্র একটি বীজের মতো যা সাতটি শীষ উৎপন্ন করে এবং প্রতিটি শীষে একশত বীজ থাকে। আল্লাহ যাদের চান তাদের জন্য বৃদ্ধি করেন। আল্লাহপাক প্রাচুর্য ও সর্বজ্ঞ, সর্বজ্ঞাতা।” বাকারাহ: আয়াত ২৬১ 

যারা যাকাত বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও যাকাত দেয় না তাদের জন্য রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ

“যারা যাকাত দেয় নাই পৃথিবীতে, তারা আখিরাতের দিন তাদের সম্পদসমূহকে তাদের দেহে ভয়ঙ্কর সাপের মতো মোড়ানো দেখতে পাবে। এই সাপগুলি তাদের শরীরকে পিষে ফেলবে, কামড় খাবে এবং বলবে – আমরা আপনার সেই সম্পদ, 

যার উপর তোমরা প্রচন্ড আসক্ত ছিলে আমরা সেই রত্ন যা আপনি গোছানোই লিপ্ত ছিলেন।” ( বুখারী) জাকাতের জন্য যোগ্য হওয়ার ন্যূনতম সম্পদকে (নিসাব) বলা হয়।

নিসাব কাকে বলে? বা যাকাত কাদের উপর ফরজ

একজন ব্যক্তির মালিকানায় এক চন্দ্র বছর পূর্ণ করার পর যে সম্পদ অবশিষ্ট বা ন্যূনতম থাকে সে সম্পদকে যাকাতের নিসাব বলে। জাকাত প্রযোজ্য সম্পদের মধ্যে রয়েছে; নগদ অর্থ, স্বর্ণ (zakat on gold), রৌপ্য, সকল প্রকার পণ্য, পশুসম্পদ এবং কিছু কৃষি পণ্য। 

যদি একজন ব্যক্তি তার মৌলিক চাহিদা মেটানোর পর এক বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ বা ৫৯৫ গ্রাম রূপা বা সমপরিমাণ নগদ বা অন্যান্য সম্পদের মালিক হন, তবে তিনি প্রতি যাকাত অর্থ বছরের জন্য সংশ্লিষ্ট হাতে থাকা সম্পদের ২.৫% হারে যাকাত দিতে বাধ্য থাকবে বা তার উপর যাকাত ফরয হবে।

যাকাত আদায়ের খাত কয়টি

আল কুরআনে যাকাত প্রদানের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সূরা তওবার ৬০ নং আয়াত অনুসারে যাকে যাকে যাকাত বণ্টন করা যেতে পারে তা হল: 

  • ১. ফকিরঃ এমন একজন দরিদ্র ব্যক্তি যার জীবিকা নির্বাহের জন্য বা বাচার জন্য সামান্য সহায় সম্পদ আছে বা নেই।
  • ২. মিসকীনঃ মিসকীন ব্যক্তি যার আয় তার জন্য এবং তার পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য অপর্যাপ্ত।
  • ৩. যাকাত আদায়কারীঃ এমন কর্মচারীগণ যিনি বা যারা যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণে নিয়োজিত।
  • ৪. মুআল্লাফাতিল কুলুব বা নও-মুসলিমঃ নতুন মুসলমান যে ব্যক্তির ঈমান এখনো পরিপক্ক হয়নি; অথবা যে কোনো অমুসলিম যে ইসলাম গ্রহণ করতে চায়, তাদের মনকে ইসলামের দ্বারা আকৃষ্ট ও উৎসাহিত করতে হবে এমন। এ ধরনের লোকদেরকে তাদের ঈমানকে শক্ত ও মজবুত ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য জাকাত দেওয়া যেতে পারে।
  • ৫.রিকাব বা ক্রীতদাসের দাসত্ব মোচনেঃ দাসত্ব থেকে মুক্ত দাসদের মুক্তিপণ হিসেবে প্রদান করা যেতে পারে।
  • ৬. গারিমিন বা দেনা পরিশোধের জন্যঃ ঋণগ্রস্থ যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে অপারগ তাকে দেওয়া যাবে।
  • ৭. ফীসাবিলিল্লাহ বা যারা আল্লাহর পথে নিয়োজিতঃ যারা আল্লাহর পথে নিয়োজিত যারা ইসলামের প্রসারে ও প্রতিষ্ঠায় সক্রিয়ভাবে জড়িত 
  • ৮. ইবনুস-সাবির বা মুসাফিরের জন্যঃ একজন মুসাফির যিনি নিজ অঞ্চল ছেড়ে অন্য কোথাও বা বিদেশ গিয়ে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন কিন্তু তা পরিশোধ করতে অক্ষম তার ক্ষেত্রে দেওয়া যাবে।

যাদের যাকাত দেওয়া যাবে না

নিসাব সম্পদের মালিকঃ যাদের ৮৫ গ্রামের মত স্বর্ণ বা ৫৯৫ গ্রাম  রৌপ্য বা নগদ অর্থ বা সমতুল্য বা অন্যান্য সমতুল্য পণ্য বা পণ্যের মালিক তাদের জন্য যাকাত আবশ্যক নয়। এমন ব্যক্তিকে যাকাত নেওয়া নিষেধ এবং তা ব্যবহার করা সে ব্যক্তির জন্য হারাম। 

নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে এমন কাউকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হবে না এবং যাকাত আদায়কারীকে আবার যাকাত দিতে হবে সঠিক ব্যক্তিকে।

নির্দিষ্ট আত্মীয়ঃ একজন ব্যক্তি তার মা, পিতা, মাতামহ, মাতামহী, দাদী, দাদা এবং তাদের পিতামাতাকে যাকাত দিতে পারে না। অনুরূপভাবে নিজ পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূ এবং পুত্রবধূগণ এবং তাদের সন্তানদেরও যাকাত দেওয়া যাবে না। 

অনুরূপভাবে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে যাকাত দিতে পারে না। উপরিউক্ত পরিজনছাড়া অন্যান্য আত্মীয়দের যেমন ভাই, বোন, খালা ও মামা, খালু ও মামী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ী, ফুফু ও ফুফা, খালাতো চাচাতো মামাতো ভাই বা বোন সমূহ, ভাতিজা, ভাতিজি ইত্যাদিকে যাকাত দেওয়া যাবে। এমনকি স্ত্রীও তার স্বামীকে যাকাত দিতে পারে।

সেবার বিনিময়েঃ কারও দেওয়া সেবার বিনিময়ে তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না। অনুরূপভাবে শিক্ষক বা সম্পত্তির পরিচর্যাকারীকেও যাকাত দেওয়া যাবে না। মজুরি হিসাবে কর্মচারী: গৃহকর্মী বা অন্য কোন কর্মচারীদের মজুরি হিসাবে যাকাত দেওয়া যাবে না। অবশ্য বেতন ব্যতীত অন্য কোনো উপহার হিসেবে তাদের জাকাত দেওয়া যেতে পারে এবং কোনো ফেরত বা কৃতজ্ঞতা পাওয়ার আশা ছাড়া দেওয়া যেতে পারে।

মসজিদ সম্পর্কেঃ মসজিদ নির্মাণ, মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যাকাত দেওয়া যাবে না।

মৃত ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ব্যয়ঃ মৃত ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বা দাফনের জন্য ব্যয় হিসেবে যাকাত ব্যবহার করা যাবে না। তবে মৃতের উত্তরাধিকারীরা যদি দরিদ্র হয় তবে তারা যাকাত গ্রহণ করতে পারে এবং তাদের মৃত আত্মীয়দের দাফন করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যবহার করতে পারে।

যাকাত হিসাব করার নিয়ম

একজন ব্যক্তিকে প্রদত্ত যাকাত তার অন্তত একদিনের চাহিদা পূরণের পরিমাণের চেয়ে কম হতে পারবেনা। উপরন্তু, যাকাত এমনভাবে দিতে হবে যাতে যাকাত গ্রহীতা জাকাতের অর্থ ব্যবহার করে স্থায়ীভাবে দারিদ্র্য থেকে নিজেদের বের করে আনতে পারে।

যদি কেউ এমন কাউকে যাকাত দেয় যার যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত বিবেচনা রয়েছে, কিন্তু পরে জানতে পারে যে যাকাত গ্রহীতার সম্পদ নিসাবের সমান আছে, অথবা যাকাত গ্রহীতার সাথে যাকাত দাতার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে (যাকাত দেওয়া নিষিদ্ধ যাদের ক্ষেত্রে), সেক্ষেত্রে যাকাত দানকারীর জাকাত আদায় হবে এবং তাকে আবার যাকাত দিতে হবেনা।

যদি কোন ব্যক্তি যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত না হয়, যদিও তাকে দেওয়া হয় জাকাত, তবে তার উচিত তা প্রত্যাখ্যান করা বা অবিলম্বে যাকাত দাতার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। কারণ, তার জন্য যাকাত নেওয়া হারাম।

যাকাতের প্রথম দাবিদাররা হচ্ছেন দরিদ্র আত্মীয়গণ। জাকাত দানকারীর প্রতিবেশীদের হক তারপরেই; তারপর পাবেন, নিজ গ্রাম/শহর বা দেশের উপযুক্ত বাসিন্দারা যারা জাকাত প্রাপ্য। জাকাত অন্য এলাকার লোকদের কাছেও পাঠানো যেতে পারে যদি তাদের প্রয়োজন বেশি ও জরুরী হয়।

যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টি

  • ১. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকানা থাকতে হবে। নিসাব অর্থ আমরা আগেই আলোচনা করেছি সেটা হলো সাড়ে ৭ তোলা সোনা, বা সাড়ে ৫২ তোলা রোপা, বা সেইপরিমাণ মূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার মালের মালিক হওয়া।
  • ২. মুসলিম হতে হবে। কাফেরদের উপর নয়।
  • ৩. বালেগ হতে হবে।
  • ৪. বিবেকবান হতে হবে। পাগল বা উন্মাদের উপর যাকাত ফরয হয় না।
  • ৫. স্বাধীন বা আটক নয় এমন ব্যক্তি হতে হবে।
  • ৬. নিজের সম্পদের উপর পরিপূর্ণ মালিকানা থাকতে হবে
  • ৭. দৈনিক প্রয়োজন হয় এমন অর্থ ছাড়া নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে শুধু তার উপরই যাকাত ফরজ হবে। 

যাকাত কখন দিতে হয়

আপনার নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলেই আপনার উপর যাকাত ফরয হবে। নিসাব কি তা আমরা প্রথমেই জানতে পেরেছি।

যাকাত ক্যালকুলেটর কি

যাকাত ক্যালকুলেটর এমন একটি ওয়ার্ড ফাইল যেটাতে যাকাতের হিসাব অতি সহজেই করে ফেলা যাই। যাকাত হিসাব করা কঠিন নয়। আপনি আমাদের জাকাতের হিসাব পত্র ব্যবহার করে নিজের জাকাতের হিসাব করতে পারেন। 

আপনারা গুগলে গিয়ে জাকাত ক্যালকুলেটর বা গণনা শীট এবং যাকাতের বই ও ফাইল ডাউনলোড করতে পারেন। তাছাড়া পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় বসেও আপনি জাকাতের হিসাব করতে পারবেন  এই ফাইল নামিয়ে। (অনলাইন থেকে সংগৃহীত)

Leave Comment